বাবু -মা,
পাইলে আমাক মাফ করি দিবেন, আমি তোমাক কষ্ট দিবার চাই না । আমি অনেক চেষ্টা করি তোমাদের দেখা ছেলেক বিয়া করবার পারলাম না । আমি ভগবান কে স্বাক্ষি করি অনেক আগেই পরিমলোক নিজের স্বামী মানি নিচি । আমি জানি তোমরা কোনও দিনও পরিমলক মেনে নিবার পারতেন না । আর আমিও তাক ছাড়া বাঁচবার পারব না । তাই আমি চলে গেলাম । আমার মরার আগে একটা অনুরোধ করবার চাই, বাবু-মা, ভগবানের দোহাই তোমরা দয়া করে আমার শেষ ইচ্ছাটা পূরন করবেন । আমি পরিমল কে আমার স্বামী হিসাবে মানি তাই আমার মরা দেহের শেষ কৃত্ত করার অধিকার আমি শুধু তাক দিলাম । তোমাদের কাছে এইটাই আমার শেষ চাওয়া । পারলে আমাক আর আমার পরিমলক ক্ষমা করে দেবেন ।
ইতি
"সাথি"
স্বামী হারা অসুস্থ বৃদ্ধা মা এর দুই ছেলে "পরিমল" আর "পরিতোষ", দু'ছেলেই কোন রকম উপার্জন করে মা এর দেখভাল করছিলো । পরিমল বড় ছেলে, সে একটা এন.জি.ও তে চাকরি করত আর পরিতোষ চট্টগ্রামে একটা গার্মেন্টসে চাকরি করত। তাদের বাড়ি খাগড়াছড়িতে ।
পাই পাই করে কিছু টাকা জমিয়েছিল পরিতোষ বিদেশ যাবে বলে । তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু জাফর কে সাথে নিয়েই বিভিন্ন এজেন্সির সাথে কথা বলতে বলতে পরিশেষে তাদের ২ জনের ই ভিসা প্রায় রেডি হয়ে গিয়েছিলো , বেশ কিছু টাকাও এতদিনে খরচ হয়ে গেছে । প্রায় শুন্য হাতে ২ জনই একটা বিশেষ কাজে ঢাকায় আসে, খুব সকালের দিকে এয়ারপোর্ট রেলস্টেশনের কাছ দিয়েই হাটছিলো ২ জনই। হঠাত তাদের চোখ পড়ে একটা ন্যাশনাল আইডি কার্ড , সরল মনে পরিতোষ কার্ডটা হাতে তুলে নিয়ে রেল স্টেশনের একজন পুলিশ কে গিয়ে দিয়ে আসতে যায় ।
পুলিশ ভাই কার্ডের ঠিকানা টা পরে বলে, ভাই এইটাতে যে ঠিকানা আছে তা এখান থেকে মাত্র ৫-৬ মিনিটের হাটার রাস্তা । এক নম্বর সেক্টরের এত নম্বর বাসা, যদি পারেন এই ঠিকানায় কার্ড টা দিয়ে আসেন যার কার্ড তার উপকার হবে ।
সরল পরিতোষ ও মেনে নেয় তার কথা টা , জাফর ও সাড়া দেয় তার প্রস্তাবে । গ্রামের প্রচন্ড সরলতার মাঝে বড় হওয়া পরিতোষ মহা আনন্দে সেই কার্ডের মালিকের বাড়িতে গিয়ে হাজির। বিড়াট বাড়ির বাড়িওয়ালা খুশি হয়ে হয়তবা দামি কিছু নাস্তা খেতে দিবে অথবা তার ভিজিটিং কার্ড টা হাতে দিয়ে বলবে কোনদিন সমস্যা হলে এই ঠিকানায় চলে আসবে । নানান কিছু ভাবতে ভাবতেই গেটে নক করল । তারা কি আর জানত তাদের ভাগ্যে কি অপেক্ষা করছে ?
আইডি কার্ড এর ব্যাপার টা শুনেই দারওয়ান উপরে ফোন দিল আর গেট খুলে তাদেরকে অপেক্ষা করতে বলল । এদিকে ওই ভদ্রলোক বাড়িতে না থাকায় দ্রুত তার স্ত্রী তাকে ফোন করলেন । তার স্বামীকে ফোন দেওয়ার সাথে সাথেই সে তার স্ত্রী কে জানালো, এরাই কাল রাতে আমার সবকিছু ছিন্তাই করেছিল, আজ আবার এসেছে বাসার ঠিকানায় , তুমি দরজা খুল না আমি পুলিশ পাঠাচ্ছি । অসহায় আর সরল ছেলে দুইটাই অপেক্ষা করতে থাকে । ৫-১০ মিনিটের ভিতর পুলিশ এসে হাজির, কোন কথা শোনার সময় নাই তাদের সরাসরি থানায় নিয়ে গেল । মহিলা নিজেই নিজের কাজের জন্য নিজেকে ধন্যবাদ দিচ্ছিলেন আর তার আত্মিয় স্বজন দের ফোন করে বলছিলেন জানিস কাল তোর দুলাভাই এর ছিন্তাইকারি গুলো ধরা পরেছে ।
পরিতোষ এর নিজের একটা ফোন ও ছিল না । আর থাকলেও ফোন করে কাকেই বা জানাবে, সে এমন একটা বিপদে পড়েছে । তার প্রিয় বন্ধু জাফর এরই মধ্যে তার ভাই এর সাথে যোগাযোগ করেছে । সারাদিন হাজতে থাকল দুই বন্ধু । থানার ওসি সাহেব তাদের সমস্ত ঘটনা শোনার পর বিশ্বাস করতে না করতেই সন্ধার একটু আগেই সেই আইডি কার্ডের মালিক এসে থানায় হাজির। সেই লোক থানায় এসে বিস্তারিত জানায় কিভাবে গত রাতে এয়ারপোর্ট এর কাছে থেকে তার সর্বস্ব লুট হয়ে যায় । যদিও রাতে তিনি কাউকেই চিনতে পারেন নাই ২৪ ঘন্টা পরে তাদের কাউকে দেখে চিনতে না পারা টাই স্বাভাবিক । তারপরও তাকে দায়িত্ব দেয়া হল যে, দেখুন তো এদের মধ্যে কেউ আছে কি না ? প্রভাবশালী ব্যক্তি কিছু না বুঝেই তাদের উচ্চতা বয়স স্বাস্থ দেখে বলে দিলেন "আমার মনে হয় এরাই হবে" । ওসি সাহেব দেরি না করেই পরের দিন কোর্টে চালান করে দিলেন । জাফরের ভাই থানায় এসে তেমন কিছু করতে না পারলেও প্রায় ২০ দিনের ভিতরেই তার ভাইয়ের জামিন করিয়ে নিয়ে যায় । বেচারা পরিতোষ, যার সাথে দির্ঘদিনের বন্ধুত্ব সেই জাফর তার আসল রুপ টা দেখিয়ে দিল, জাফর আসলেই মীরজাফরের কাজ টাই করল ।
নিশ্চই রাগ করছেন পরিমল আর সাথীর কি হল ? বলছি তো .....
আমি> ভাই, নামাজ পড়বেন না ?
পরিতোষ> ভাই, আমি তো হিন্দু । হাসতে হাসতে জবাব দিলো পরিতোষ ।
আমি> ও সরি আপনার দাড়ি দেখে কিন্তু মনে হয় না আপনি হিন্দু । আপনার কি কেস ভাই ?
পরিতোষ> অনেক কাহিনী ভাই পড়ে একদিন শুইনেন । ঠিক আছে ভাই এখন না বললে নাই ।
আপন মনে সুতা দিয়ে মাদুলি / শিকে বানাতে থাকল আবার । আমি নামাজ পড়েই আবার তার পাশে গিয়ে বসলাম, ভাই এগুলা বানায় কি করেন ?
বিক্রি করি, পরিতোষ এর উত্তর !!!
বলেন কি !! জেলের ভিতর এগুলা কে কিনে ?
ওই দেখেন উপড়ে, ঢাকা কেন্দ্রিও কারাগারের হাজতি দের থাকার একটা ইউনিট মণিহার এর ৩য় তলার দুই কোনায় তাকিয়ে দেখি ১০/১২ টা মাদুলি বা শিকে সবাই তাদের থালাবাটি বা কেউ কেউ কাপড় ঝুলায় রাখছে ।
বুঝলাম তিনি আসলেই একটা গুরুত্বপুর্ন কাজ করছেন । একটা শিকের দাম ২টা লাল বা একটা গোল্ডেন ।
মানে হল ২টা গোল্ডলিফের প্যাকেট বা ১টা ব্যান্সনের পাকেট । জেলের ভিতর বেচাকেনার একমাত্র মূদ্রা হলো এই লাল আর গোল্ডেন । সে অন্য প্রসঙ্গ, বাদ দিন । প্রায় ১ সপ্তাহ লেগে গেল তার ইতিহাস টা শোনার জন্য ।
আমি চোখে পানি ধরে রাখতে পারি নাই, যখন জানলাম তার জেলের বয়স হল প্রায় ৫ বছর তাও আবার বিনা অপরাধে ।
কারন জানতে চাইলে সে বলে, আমি যে জেলে আছি তা আমার পরিবারের কেউ ই জানে না । আর তার সেই বিস্বস্ত বন্ধুটার ব্যাপারে জানতে চাইলে সে তখনো বলে যে, হয়তবা সে এতদিনে বিদেশে চলে গেছে । আর জাফর আমার জন্য কি বা করতে পারত ? আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম এত সহজ-সরল মানুষ আজও আমাদের সমাজে আছে নাকি ? আমি মনে মনে ভাবি ওই মীরজাফর কে আল্লাহ কোনদিন ও সুখে রাখতে পারে না । সে আরও জানালো তার একমাত্র ভাই পাগল আর আমার মা এতদিনে বেঁচে আছেন কি না জানি না । আমি তার কাছে জানতে চাইলাম আপনার জামিন করাতে কি কি লাগবে? সে বলল যে, যদি কেউ আমার জন্য একজন উকিল নিয়োগ করে তাহলে আমি জামিন পেয়ে যাব । সেইদিনের মত কথা এখানেই শেষ ।
অন্য একদিন তার ভাইয়ের ব্যাপারে জানতে চাইলে আবার হতবাক হয়ে যাই, তার ভাইয়ের জীবন এর নির্মম সত্যটা জেনে বুঝলাম
"বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না,অনেক দুরেও ঠেলিয়া দেয়"
বড় ভাই পরিমল, ছোট কাল থেকেই মায়ের ভক্ত । লেখাপড়া বেশি করতে না পারলেও একটা চাকরি ঠিকই যোগার করেছিল । বেতন যাই পেত পুরটাই সংসারের কাজে লাগাত, মা এর চিকিৎসা , বাজার করা এমন কি মাঝে মাঝে নিজেই রান্না করেও খাওয়াত সবাইকে । বয়স খুব বেশি ছিল না, মাত্র ২২ বছর বয়সেই সংসারের হাল ধরতে বাধ্য হয় পরিমল । এমনই একটা নিরীহ গোবেচারা ছেলেকে ভালবেসে ফেলে তারই প্রতিবেশি "সাথী" ।
একটু একটু করে তাদের প্রেমের কথা জানাজানি হয়ে যায় । পরিমল আর সাথী দুজন দুজন কে জীবন দিয়ে ভালোবাসে । দুজনেরই একই স্বপ্ন , ছোট্ট একটা সুখের সংসার হবে তাদের । একদিন না দেখলে ব্যাকুল হয়ে যেত দুজনই , এভাবে প্রায় ৫ বছর চলে যায় । বিভিন্ন সময় সাথীর জন্য যত প্রস্তাব আসত সবগুলই কোন না কোন ভাবে বাতিল হলেও শেষমেশ সাথীর বাবা এবারে পাত্র পক্ষের সাথে দিন তারিখ সব ঠিক করে ফেলেন ।
বিয়ের দিন যতই ঘনিয়ে আসে সাথী আর পরিমল দুই জনেই পাগল হতে থাকে । শেষমেশ সাহস করে পরিমল আবারো সাথীদের বাসায় তার মা কে নিয়ে গিয়ে যে একটা অপমানিত হয়েছে তার চেয়ে মরে যাওয়াই ভাল ছিলো । সাথীও তার বাবার পা ধরে আনেক কেঁদেও কোন লাভ হয় নাই । পাষণ্ড বাবা ভেবেছিল বিয়ে দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে । এমন কি সাথীকে অনেক বার মার-ধর ও করে তার বাবা । অসহায় সাথী সারাদিন রাত কেঁদেকেটে বুক ভাসিয়েও তার বাবার মন নরম করতে পারে নাই । পরিশেষে বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসলে সাথী পরিমলের সাথে শেষ দেখা করে তার পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করে বলে আমাকে ক্ষমা করে দিও । আমি শুধু তোমার ছিলাম আর তোমারি থাকব ।
সাথী অনেক বার পরিমল কে বলেছিল চল পালিয়ে যাই, কিন্তু পরিমলের সেই সাহস হয় নাই, সে তার অসুস্থ্য মাকে ছেড়ে কি ভাবে পালিয়ে যাবে এই কথা ভেবেই ওই পদক্ষেপ নিতে পারে নাই । অবশেষে বিয়ের রাতেই ঘটল সেই দূর্ঘটনা । সাথী তার নিজের ঘড়ে ফ্যানের সাথে ওড়না পেঁচিয়ে চিরতরে চলে গেল ওপারে আর জানিয়ে গেল তার ভালোবাসার মানুষের প্রতি তার ভালোবাসার গভীরতা ।
নিস্তব্ধ পাশন্ড বাবা, পরিমল কে তার সাথীর হাতের লেখা শেষ চিঠিটা ধরিয়ে দিয়ে বলে আমাকে ক্ষমা করে দাও বাবা । আমরা ভুল করেছি, অনেক বড় ভুল ।
ময়নাতদন্ত শেষে লাশ শ্মশান-এ নিয়ে গেলে পরিমল ছুটে যায় তার সাথিকে এক নজর দেখতে । পাগলের মত হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে পরিমল । গ্রামের মানুষগুলোও চোখের জল ধরে রাখতে পারছিলো না । এরই মাঝে সাথীর শেষ ইচ্ছের কথা সবাই জেনে গেছে । পরিমল কে দায়িত্ব দেয়া হল মুখাগ্নি করার জন্য । নিয়মানুসারে পরিমল পানি ভর্তি মাটির কলসি কাঁধে নিয়ে তৃতীয়বার বা শেষবারের প্রদক্ষিন শেষ করতে না করেতেই মাথা ঘুরে পরে যায় তার ভালোবাসার সাথীর চিতার পাশেই । তার পক্ষে আর সম্ভব হয় না মুখাগ্নি করা, কিছু সময় পর পরিমলের জ্ঞান ফিরলেও আজও তার মস্তিস্কের স্মৃতি ফিরে আসে নাই ।
সত্যই তাদের প্রেম ছিল অনেক অনেক বড় ।
সেই প্রেমের মরা পরিমল কে পরিতোষের জেলে থাকার খবরটা দিলেই কি আর না দিলেই বা কি ?
অল্প কিছুদিনের ভিতর আমার জামিন হয়ে গেল । আসার আগে আমি তাকে বলে আসি আমি জেল থেকে বের হয়ে আপনার কেস টা একজন উকিলের সাথে পরামর্শ করব । আমি বের হয়ে এক টা দিনও নষ্ট না করে চলে গেলাম উকিলদের আস্থানায় মাত্র ২ জন উকিল এর সাথে কথা বলেই ৩য় জনের কাছে জানতে পারলাম এটা কোন ব্যাপারই না , ৭ দিনের ভিতর জামিন হয়ে যাবে । আমি ভেবেছিলাম না জানি কত টাকা লাগবে ? তিনি আমার কাছ থেকে প্রথম দিন মাত্র আঠারশ টাকার মত নিলেন আর পরে আর একদিন কিছু টাকা। মাত্র ৩ হাজার টাকার মত খরচ হলো আর এক মাসের ভিতর তার জামিন ও হয়ে গেল ।
আমি নিজেই অধির আগ্রহে তার জন্য জেল গেটে অপেক্ষা করতে লাগলাম । কেননা পরিতোষের কাছে একটা টাকাও থাকবে না, খাগড়াছড়ি যাওয়া তো দূরের কথা এক বেলা খাবার টাকাটাও তার কাছে নাই । সন্ধ্যার একটু আগে জেলের প্রধান গেট দিয়ে বের হলো পরিতোষ, মাত্র এক মাস পর দেখা হলেও আমি তাকে চিনতেই পারছিলাম না, কেননা তার হুজুরের মতন বড় বড় দাড়িগুলো ক্লিন সেভ করে দিয়েছিল জেল থেকে বের হবার সময় ।
যা হউক, আমি তাকে মোহাম্মদপুরে আমার বাসায় নিয়ে গেলাম , আমার কিছু পুরাতন কাপড় আর একটা নতুন লুঙ্গি দিলাম । ভালো করে গোসল করে দুই জন একসাথে রাতের খাবার খেলাম । অনেক রাত পর্যন্ত জেলের ভিতরের গল্প করলাম সেই সময়ের পরিচিত ভাইদের কার কি অবস্থা জানতে চাইলাম । পরের দিন বাসে উঠিয়ে দিলাম খাগড়াছড়ি গিয়ে দোকান থেকে ফোন করে জানালো সে ঠিকমত পৌছায় গেছে । এর পর ৩/৪ বার হাজিরা দিতে আসতে হয়েছিলো , আমিও আমার কাজে ব্যাস্ত হয়ে গেলাম । অনেক বার ভেবেছিলাম তার কেস নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাব, খুজে বের করব সেই ভদ্র বেশের শয়তান লোকটাকে যার মুখের একটা স্টেটমেন্টের কারনে নিরীহ , আসহায় আর সরল পরিতোষের জীবন থেকে ৫ টা বছর নষ্ট হয়ে গেল ।
ভালো থেকো পরিতোষ, পারলে ক্ষমা করে দিও ।
Notes. এটি একটি সত্য ঘটনা। আমি পরিতোষকে হারিয়ে ফেলেছি। তার পক্ষে একটি মামলা করতে চাই। আপনারা যদি তার কোন সন্ধান পেয়ে থাকেন দয়া করে জানাবেন।